ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার হাতে তৈরি ঐতিহ্যবাহী আখ থেকে হাতে তৈরি `লাল চিনি’ ভৌগলিক নির্দেশক বা জিআই (Geographical Indication) পণ্যের স্বীকৃতি পেয়েছে। এই চিনি সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপায়ে, রাসায়নিক ব্যবহার ছাড়াই, শুধুমাত্র আখের রস থেকে তৈরি হয়, যা এটিকে একটি বিশেষ ও ঔষুধি গুণসম্পন্ন খাদ্যপণ্যে পরিণত করেছে। এই প্রক্রিয়ায় ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, আয়রন এবং ম্যাগনেশিয়ামের মতো খনিজ উপাদান পাওয়া যায়।
ফুলবাড়িয়া উপজেলার কৃষকের আবাদ করা অন্যতম ফসল আখ। এই আখ থেকে হাতে তৈরি লাল চিনি স্বাদে ভরপুর। এবার সেই লাল চিনি পেয়েছে জিআই পণ্যের মর্যাদা পাওয়ার খবরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।
জানা যায়, পৌষ মাসের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে একটানা ফাল্গুন-চৈত্র মাস পর্যন্ত চলে আখ মাড়াই ও হাতে তৈরি লাল চিনি তৈরির হিড়িক। ওই সময়টাতে লাল চিনি তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করে উপজেলার বাকতা, কালাদহ, এনায়েতপুর এবং রাধাকানাই ইউনিয়নের প্রায় ২০টি গ্রামের কৃষক-কৃষানিরা। জ্বাল ঘরে কড়াইয়ে আখের রস জ্বাল দেওয়ায় দূর থেকে বাতাসে ভেসে আসে গরম গরম লাল চিনির ম ম ঘ্রাণ।
লাল চিনি দিয়ে শুধু শরবত নয়, এটি দিয়ে মুড়ির মোয়া, পিঠা-পায়েস, চিড়ার নাড়ু, খিরসহ বাহারি মিষ্টিজাতীয় রান্নায় যুগ যুগ ধরে এই জনপদের মানুষের কাছে এই চিনি বেঁচে আছে গ্রামীণ ঐতিহ্য হিসেবে।
পৌষের শেষ দিকে শুরু হয়ে চৈত্র মাস পর্যন্ত চলে আখ মাড়াইয়ের কার্যক্রম। আখ মাড়াই করে রস বের করার সময় ফুলবাড়িয়ার গ্রামে গ্রামে শুরু হয়ে যায় উৎসবের আমেজ। খবর দেওয়া হয় পরিবারের দূর-দূরান্তের আত্মীয় স্বজনদের। মেয়ে, মেয়ের জামাই, কিংবা ছেলের শ্বশুরবাড়ির লোক, বোন, মামা, ফুফা, খালা-খালু, শ্যালক-শ্যালিকাসহ গ্রামের সবাই মিলে একে অপরকে সহযোগিতার মাধ্যমে সকাল থেকে মধ্য রাত পর্যন্ত আখের রস জ্বাল করে হাতে তৈরি করা হয় লাল চিনি। বড়দের পাশাপাশি শিশু, কিশোর-কিশোরীরাও সমান তালে কাজ করে ঐ সব গ্রামে।
লাল চিনি দিয়ে তৈরি হয় মজাদার খাবার ‘খির’। এখনও ফুলবাড়িয়ায় নতুন জামাইকে শাশুড়ি গরম খির খাইয়ে আদর করে থাকেন। গ্রামে প্রবাদ রয়েছে ‘করলে তৈরি লাল চিনির খির, খাওয়ার জন্য পড়ে যায় ভিড়।’
বাংলাদেশে একমাত্র ফুলবাড়িয়াতেই তৈরি হয় এই লাল চিনি। ফুলবাড়িয়া উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নের মধ্যে পাঁচটিতে পাহাড়ি লাল মাটিতে এক সময় প্রচুর পরিমাণে আখের আবাদ হতো। অন্য ফসলের তুলনায় দামের দিক দিয়ে কম, আখ চাষে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাও কম। ফলে আখ চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করছেন অনেক কৃষক। দিনে দিনে ফুলবাড়িয়ায় কমছে হাতে তৈরি লাল চিনির উৎপাদন। তবে ইদানিং বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষেরা চিনি সংগ্রহের আগ্রহ প্রকাশ করায় বেড়েছে চাহিদা। পাল্লা দিয়ে দামও বেড়েছে।
ফুলবাড়িয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ নূর মোহাম্মদ বলেন, ‘এ স্বীকৃতির কার্যক্রম অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছিল। এমন খবরে আমরা উচ্ছসিত। এতে কৃষকরা আরও সাহস পাবে। ফুলবাড়িয়ার লাল চিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গন্ডি পেরিয়ে বিশ্ব অর্থনীতিতে স্থান করে নিবে। পেটেন্ট, শিল্প-নকশা ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তরে তাদের ওয়েবসাইটে ২৫ জুলাই-২০২৫ এর মধ্যে কোন আপত্তি না থাকায় ৩১ জুলাই চূড়ান্ত তালিকায় ৫৮ নম্বর রেজিস্ট্রেশনভুক্ত হয়।’
ফুলবাড়িয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘খুবই খুশির খবর। আমার সময়ে পূর্ণতা পেয়েছে, ফুলবাড়িয়ার লাল চিনির জিআই স্বীকৃতির কাজ শুরু হয়েছিল অনেক আগে। এ অঞ্চলের একটা পণ্য দেশ ও দেশের বাহিরে যাবে খুবই গর্বের। আমরা আজকেই সরকারি সনদ পেতে যথাযথ প্রক্রিয়ায় আবেদন করেছি।’


