Saturday, December 13, 2025
Advertisement
Home কৃষি ক্যাম্পাস হাঁসের প্লেগ রোগের ভ্যাকসিন উদ্ভাবন, প্রতিটিতে খরচ মাত্র ২ টাকা

হাঁসের প্লেগ রোগের ভ্যাকসিন উদ্ভাবন, প্রতিটিতে খরচ মাত্র ২ টাকা

মাংসের স্বাদ ও পুষ্টিগুণ বিবেচনায় হাঁসের মাংস সেরা। তবে হাঁসের মধ্যে নানা ধরনের রোগের সংক্রমণ হলেও তার মধ্যে সবচেয়ে মরণঘাতী হচ্ছে হাঁসের প্লেগ। এই রোগটি হারপেসভিরিডি (Herpesviridae) পরিবারের এক ধরনের ডিএনএ ভাইরাসের সংক্রমণে হয়ে থাকে। ১৯২৩ সালে নেদারল্যান্ডসের বিজ্ঞানী বাউডেট প্রথম এ রোগটি শনাক্ত করেন। পরবর্তীতে ভারতবর্ষেও এই রোগের জীবাণু শনাক্ত হয়। হাঁসের প্লেগ রোগটি ডাক এন্টারাইটিস নামেও পরিচিত, কারণ এই ভাইরাসটি হাঁসের পরিপাকতন্ত্রে মারাত্মক ক্ষতি করে থাকে।

প্রাপ্তবয়স্ক হাঁসের মধ্যে এক ধরনের জীবাণুর সংক্রমণের কারণে হঠাৎ হাঁসগুলো ছটফট করে মারা যায়। এ ছাড়া হাঁসগুলো খাবার গ্রহণ কমিয়ে দেয়, রক্তমিশ্রিত পায়খানা করে, পালক এলোমেলো হয়ে যায়, দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ঝিমিয়ে থাকে এবং ডিম উৎপাদন কমে যায়। এই রোগটি আক্রান্ত হাঁসের ব্যবহৃত পানি, খাদ্যদ্রব্য ও খামারের যন্ত্রপাতির সংস্পর্শে অন্য হাঁসেও সংক্রমিত হতে পারে। এ ছাড়া বাজারে প্লেগে আক্রান্ত অসুস্থ হাঁস কেনাবেচার মাধ্যমে এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায়ও এ রোগ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

খামারিদের এই সমস্যা বিবেচনা করে দীর্ঘ গবেষণার পর বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড হাইজিন বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. বাহানুর রহমান হাঁসের প্লেগ রোগের নতুন দুই ধরনের ভ্যাকসিন উদ্ভাবন করেছেন। ভ্যাকসিন দুটি হলো— ইনঅ্যাক্টিভেটেড (নিষ্ক্রিয়) ও লাইভ অ্যাটেনুয়েটেড (দুর্বল অণুজীব) ভ্যাকসিন। এই ভ্যাকসিন হাঁসে একবার প্রয়োগ করলে ছয় মাস পর্যন্ত প্লেগের জীবাণু সংক্রমণ থেকে সুরক্ষা পাওয়া যাবে। পরবর্তী বুস্টার ডোজ প্রয়োগের মাধ্যমে পুরো খামারকে জীবাণুর সংক্রমণ থেকে মুক্ত রাখা সম্ভব হবে।

ভ্যাকসিন উদ্ভাবনের এই প্রকল্পটি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর অর্থায়ন করেছে। খামারিদের কাছে দ্রুত এই ভ্যাকসিন পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে সম্প্রতি ভ্যাকসিনের সিড প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের নিকট হস্তান্তর করা হয়েছে। প্রতি হাঁসের ভ্যাকসিনের খরচ মাত্র দুই টাকা, যা খামারিদের জন্য বেশ সাশ্রয়ী।

হাঁসের এই প্লেগ রো‌গের সংক্রামণ প্রতি‌রোধ করার জন‌্য প্রথ‌মে দুই সপ্তাহ বয়‌স ভ‌্যাক‌সিন প্রয়োগ কর‌তে হয়। পরবর্তী ৬ সপ্তাহ বয়‌সে আ‌রেকবার ভ‌্যাক‌সিন দি‌তে হয়। এরপর ৬ মাস পরপর ভ‌্যাক‌সিন দি‌লে সব‌চে‌য়ে বে‌শি কার্যকর হয়। ত‌বে ভ‌্যাক‌সিন দেওয়ার পরও এই রো‌গের সংক্রামণ প্রতি‌রোধের জন‌্য হাঁসের স‌ঠিক ব‌্যবস্থাপনাও জরু‌রি।

২০২৩ সালের ৭ মার্চ হাঁসের প্লেগ রোগের সংক্রমণ প্রতিরোধে এই ভ্যাকসিন উন্নয়ন প্রকল্প শুরু হয়। এর সময়সীমা ২০২৬ সালের ৬ মার্চ পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা ও মান আরও উন্নয়নের জন্য সময়সীমা বাড়ানোর আবেদন করা হবে বলে জানিয়েছেন গবেষক।

গবেষক অধ্যাপক ড. মো. বাহানুর রহমান বলেন, ‘হাওর অঞ্চলে কাজ করতে গিয়ে আমি দেখেছি ডাক কলেরা ও ডাক প্লেগ রোগের ভয়াবহতা। খামারে হাঁসের মধ্যে ডাক কলেরা ও ফাউল পক্স ভ্যাকসিন ব্যবহারের পরও ৪০ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত মৃত্যু হ‌য়ে‌ছে। এটি আমা‌কে একটি নতুন ও কার্যকর প্লেগ ভ্যাকসিন উদ্ভাবনের প্রয়োজনীয়তাকে স্পষ্ট করেছে। প্রান্তিক খামারিরা এই ভ্যাকসিনের জন্য বারবার অনুরোধ করতেন। চোখের সামনে হাঁস ছটফট করে মারা যেত। এই রোগের বিস্তার রোধে আমরা এই উদ্ভাবনে কাজ করেছি। আমরা আগে শুধু খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে ভাবতাম, এখন ভাবছি জীব নিরাপত্তা নিয়েও ভাব‌ছি।;

তিনি বলেন, ‘দেশের যত উদ্ভাবন হয়েছে, তার পেছনে বাকৃবির অবদান বিশাল। খাদ্য নিরাপত্তা থেকে শুরু করে কৃষির প্রতিটি অগ্রগতিতে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা অনস্বীকার্য। আমার গবেষণাও এমন একটি প্রচেষ্টা, যা থেকে অন্যরা অনুপ্রেরণা পাবে। বাকৃবিতে অনেক মেধাবী ও দক্ষ গবেষক রয়েছেন, যারা যথাযথ ফান্ডিং পেলে আরও বড় সাফল্য অর্জন করতে পারবেন।’

বাকৃবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ. কে. ফজলুল হক ভূঁইয়া বলেন, ‘বাংলাদেশের লাইভস্টক সেক্টরের উন্নয়নের জন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে দুটি বিষয়ে— প্রজনন ও ভ্যাকসিন। এই দুটি ক্ষেত্র ছাড়া দেশের প্রাণিসম্পদ টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই গুরুত্বপূর্ণ খাত দুটিতে সরকারের বিনিয়োগ এখনো খুবই সীমিত। অথচ যদি প্রজনন ও ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে আমাদের পর্যাপ্ত সক্ষমতা থাকত, তাহলে বাংলাদেশের লাইভস্টক সেক্টরকে রপ্তানিমুখী করা সম্ভব হতো। আমি বিশ্বাস করি, এই ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা অত্যন্ত ভালোভাবে যাচাই করা হয়েছে। এটি মাঠ পর্যায়ে পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে এবং কন্ট্রোল ও ট্রিটমেন্ট গ্রুপের তুলনামূলক বিশ্লেষণের মাধ্যমে ফলাফল মূল্যায়ন করা হয়েছে। সবগুলো ধাপ সফলভাবে অতিক্রম করে ভ্যাকসিনটি কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। এটি দেশের প্রাণিসম্পদ খাতে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করবে।’

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -

সর্বশেষ

কমলা চাষ করে সফল মাদারীপুরের রাসেল

মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার দত্তপাড়া মৃধাকান্দি এলাকায় কমলা চাষ করে নতুন সম্ভাবনার দিগন্ত উন্মোচন করেছেন তরুণ উদ্যোক্তা রাসেল হোসেন।দীর্ঘ প্রবাস জীবন শেষে দেশে ফিরে বাবার...

পুরোনা আলু সংরক্ষণ করার অনুরোধ কৃষি উপদেষ্টার

আলুচাষিদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ডিসেম্বর পর্যন্ত পুরোনো আলু সংরক্ষণ করতে বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনকে অনুরোধ জানিয়েছেন কৃষি ও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো....

দেশে ব্রুসেলা জীবাণুর ভ্যাকসিন উদ্ভাবন

দেশে গবাদিপশুর অন্যতম পরিচিত রোগ হলো ব্রুসেলোসিস। ব্রু‌সেলা অ‌্যা‌বর্টাস (Brucella abortus) নামক এক ধরনের ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে এ রোগ হয়। এই জীবাণুতে গবাদিপশু আক্রান্ত হ‌লে...

ইউটিউব দেখে ‘কালো ধান’ চাষে সাফল্য

ব্ল‍্যাক রাইস বা কালো ধান। কেউ বলেন ‘প্রিন্স অফ রাইস’। এ ধানের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। এ চাহিদা মেটাতে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের উত্তরবঙ্গের কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার...