মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড ফরিদা আখতার বলেছেন, ‘এই দেশে এক সময় মুক্ত জলাশয়ের মাছ উৎপাদন ছিল প্রায় ৬০ শতাংশ আর বদ্ধ জলাশয়ের মাছ ছিল ৪০ শতাংশ, কিন্তু বর্তমানে এটি পরিবর্তিত হয়ে মুক্ত জলাশয়ের মাছ উৎপাদন ৪০ শতাংশ হয়ে গেছে। ফলে অনেক দেশীয় মাছ এখন বিলুপ্তের পথে।’
রবিবার বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) “বার্ষিক গবেষণা অগ্রগতি (২০২৪-২৫) পর্যালোচনা ও পরিকল্পনা প্রণয়ন (২০২৫-২৬)” শীর্ষক কর্মশালায় তিনি এসব কথা বলেন।
ড. ফরিদা আখতার বলেন, ‘এমন পরিবর্তন আমরা চাই না, কোনটাই যেন না কমে সে বিষয়ে আমাদের কাজ করতে হবে। জমি ভরাট হয়ে যাচ্ছে, হাওরে ট্যুরিজম হচ্ছে। ট্যুরিজমের কারণে মাছের কি ক্ষতি হচ্ছে সেটি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে না। যা আমাদের ভাবার কারণ। আমরা পরিবেশের ক্ষতির কথা বলি কিন্তু মাছের ক্ষতির কথা বলি না। মাছের প্রজনন ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রিত ট্যুরিজম করার নীতিমালা দরকার। হাওর অঞ্চলে এক সময় কৃষির কাজ হয়, অন্য সময় পানিতে ডুবে থাকে। কৃষির কাজের কীটনাশক ব্যবহার হয়। সেই কীটনাশকের প্রভাব পরবর্তীতে মাছের বাস্তুতন্ত্রে কি প্রভাব ফেলে সেটির গবেষণা হয়নি। বিএফআরআইয়ের মাধ্যমে এসব গবেষণা করে এর জন্যে কাঙ্খিত সমাধানও করা বের করা উচিত। অবৈধ জালের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের শুধু বদ্ধ জলাশয়ের মাছে দিয়ে হবে না, আমাদের মুক্ত জলাশয়ের মাছ লাগবে। মুক্ত জলাশয়ের মাছের উৎপাদন কেন কমে যাচ্ছে এবং এটি বৃদ্ধির জন্যে কি করণীয় তার জন্যে গবেষণা করা জরুরি। শুধু তাই নয় সমুদ্রেও মাছের সংখ্যা কমে যাচ্ছে অতি আহরণের কারণে। আমাদের নিয়ন্ত্রিত উপায়ে আহরণ করতে হবে। আমরা দ্রুতই করতে লাভ চাই। যে কারণে ভবিষ্যৎ নষ্ট হচ্ছে। এ বিষয়ে আমরা উদ্বিগ্ন।’
কর্মশালার উদ্বোধন করেন প্রধান অতিথি সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব আবু তাহের মুহাম্মদ জাবের। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশনের চেয়ারম্যান ফারাহ শাম্মী, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মো. রফিকুল ইসলাম সরদার এবং মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মো. আবদুর রউফ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিএফআরআইয়ের মহাপরিচালক ড. অনুরাধা ভদ্র।
ড. মোহাম্মদ আশরাফুল আলম বলেন, বিএফআরআই গবেষণায় সুবর্ণ রুই, পুষ্টি সমৃদ্ধ ছোট মাছ চাষ প্রযুক্তি, দেশীয় প্রজাতির প্রজনন ও সংরক্ষণে সফলতা, রাঁজপুটি উদ্ভাবন, বটম ক্লিন পদ্ধতিতে দেশীয় মাছ চাষ, ডিএনএ বারকোডিংয়ের মাধ্যমে ৭৫টি প্রজাতি শনাক্তকরণ, মাছের ভ্যাকসিন উদ্ভাবন, ছোট চিংড়ির চাষ ব্যবস্থাপনা, কাপ্তাই লেকে কার্পজাতীয় নতুন প্রজাতি শনাক্তকরণ, ইলিশ সম্পদ ব্যবস্থাপনা, হাওর সম্পদ সংরক্ষণ, উন্মুক্ত জলাশয়ে খাঁচায় মাছ চাষ, কুঁচিয়া ও কৈ মাছের চাষ, সীড উইড প্রযুক্তি উন্নয়ন এবং সুনীল অর্থনীতিতে মৎস্য খাতের সম্ভাবনা নিয়ে উল্লেখযোগ্য সাফল্য এসেছে।
আবু তাহের মোহাম্মদ জাকের বলেন, ‘মৎস্য উন্নয়ন ও গবেষণার সাথে জড়িত বিজ্ঞানীদের যথাযথ সম্মান দিতে পে কমিশনের কাছে তাদের বেতন কাঠামো বৃদ্ধির সুপারিশ করা হবে। আমাদের অনেক স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী বেকার অবস্থায় আছে, অথচ এ প্রতিষ্ঠানে আমরা শূন্যপদ খালি রেখেই বসে আছি। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করা অত্যন্ত দুঃখজনক।’
তিনি বলেন, ‘নতুন ও উন্নত জাতের মাছের প্রজনন ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তন আর্থসামাজিক পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে, নদীগুলোতে দূষণ বাড়ছে। যার ফলে মৎস্যসম্পদ মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পড়েছে। পাশাপাশি সমুদ্র থেকে মাছ আহরণে প্রযুক্তিগত দক্ষতা বাড়ানো এখন সময়ের দাবি।’
দিনব্যাপী আয়োজনে টেকনিক্যাল সেশনে বিএফআরআইয়ের ৫টি কেন্দ্র ও ৫টি উপকেন্দ্র থেকে আগত বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাগণ ৫০ টি গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।
কর্মশালা শুরুর আগে সকাল ৮টার দিকে সচিব আবু তাহের মুহাম্মদ জাবের বিএফআরআইয়ের গবেষণা মাঠ পরিদর্শন করেন। এ সময় তিনি জায়ান্ট পাঙ্গাস (Pangasianodon gigas)-এর কৃত্রিম প্রজনন ও চাষ পদ্ধতি উন্নয়ন প্রকল্প, মহাশোল মাছের ব্রুড উন্নয়ন ও প্রজনন গবেষণা, দেশীয় মাছের সংরক্ষণ, গুড়া চিংড়ি চাষ, কৈ মাছের প্রজনন ও চাষ প্রযুক্তি, কুঁচিয়া মাছের ব্রিডিং এবং বটম ক্লিন ইউনিট প্রকল্পসহ চলমান গবেষণা কার্যক্রম ঘুরে দেখেন।
গবেষকদের মতে, মেকং নদীর জায়ান্ট পাঙ্গাস বর্তমানে বিএফআরআইতে সফলভাবে বড় হচ্ছে। মাছগুলোর ওজন ১২০-১৪০ কেজি হলেও ২০০ কেজির ওপরে ব্রুডে আসে। তারা আশা করছেন, দেশে এই প্রজাতির ব্রুড তৈরি সম্ভব হলে মৎস্য খাতে নতুন বিপ্লব ঘটবে।
এ ছাড়া বিলুপ্তপ্রায় মহাশোল মাছ সংরক্ষণে কৃত্রিম প্রজনন, নার্সারি ব্যবস্থাপনা ও চাষ প্রযুক্তি উদ্ভাবনে ইতোমধ্যে বিএফআরআই সাফল্য পেয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এসব গবেষণা শুধু উৎপাদন বাড়াবে না, বরং দেশের জলজ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।


