Saturday, December 13, 2025
Advertisement
Home কৃষি ক্যাম্পাস গাবা সমৃদ্ধ খাদ্যে কমবে ব্রয়লারের মৃত্যু, বাড়‌বে ওজন

গাবা সমৃদ্ধ খাদ্যে কমবে ব্রয়লারের মৃত্যু, বাড়‌বে ওজন

বাকৃ‌বি গ‌বেষণা

বাংলাদেশে ব্রয়লার খামারিদের জন্য তীব্র গরমের মৌসুম একটি বড় চ্যালেঞ্জ। উচ্চ তাপমাত্রা (সাধারণত ৩০ থেকে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার বেশি) যখন দীর্ঘসময় ধরে থাকে, তখন মুরগির শরীরের স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যাহত হয়। এ সময় ব্রয়লারের খাবার গ্রহণের পরিমাণ কমে যায়, ফলে ওজন বৃদ্ধি ধীর হয়ে যায়। এছাড়া বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস, হাঁপানি ও শ্বাসকষ্ট, কোষ নষ্ট হওয়া এমনকি মৃত্যুহারও বেড়ে যায়। ফলশ্রুতিতে ব্রয়লারের উৎপাদন কমে যায়, যার প্রভাব পড়ে পুরো পোলট্রি শিল্পের ওপর।

এমতাবস্থায় নিরাপদ, রোগ প্রতিরোধসম্পন্ন ও অধিক উৎপাদনক্ষম ব্রয়লার মুরগির জন্য আদর্শ হতে পারে গাবা (গামা এমাইনোবিউটারিক এসিড) সমৃদ্ধ খাদ্য। গবেষণায় দেখা গেছে, গাবা সমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণের ফলে ব্রয়লারের গড় ওজন সাধারণ ব্রয়লারের তুলনায় প্রায় ১২ থেকে ১৫ শতাংশ বেশি হয়। পাশাপাশি, খাদ্যের রূপান্তর হার উন্নত এবং গরমে সৃষ্ট তাপমাত্রা জনিত চাপের (হিট-স্ট্রেস) লক্ষণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। ফলে, ব্রয়লার মুরগির মৃত্যু হার কমে গেছে।

উষ্ণ পরিবেশে ব্রয়লার পালনের চ্যালেঞ্জ ও গাবা সমৃদ্ধ খাদ্যের সমাধান বিষয়ে গবেষণা শেষে এমনটাই জানিয়েছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) ফিজিওলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহা. ইলিয়াছুর রহমান ভূঁইয়া। তিনি “ডেভেলপিং হিট রেসিস্টেন্ট ব্রয়লারস: ইনহেনসিং পারফরম্যান্স উইথ গাবা এনরিচড ফিড” শীর্ষক গবেষণা প্রকল্পের সহযোগী গবেষক হিসেবে কাজ করেছেন।

জানা যায়, ঢাকা ব্যাংক পিএলসির অর্থায়নে গত বছরের সেপ্টেম্বরে গবেষণা প্রকল্পটি শুরু হয়। শের-ই-বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এর যৌথ পরীক্ষামূলক ল্যাবরেটরি গবেষণা ও ফিল্ড ট্রায়াল গবেষণায় গাবা সমৃদ্ধ খাদ্যের সাফল্যের দাবি করেন সংশ্লিষ্ট গবেষকেরা।

ড. ইলিয়াছুর রহমান জানান, গাবা হলো এক ধরনের প্রাকৃতিক অ্যামাইনো অ্যাসিড জাতীয় যৌগ, যা ব্রয়লারের স্নায়ুতন্ত্রকে শান্ত রাখে এবং শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। তাপ ও চাপ কমে গেলে মুরগির গ্রহণকৃত খাদ্যের কার্যকারিতা বাড়ে, যা দ্রুত ওজন বাড়ায় এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বজায় রাখে। এর ফলে মৃত্যুহার কমে এবং অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়। এর স্বাদ ও গন্ধ সাধারণ ব্রয়লার মুরগির মতো নয়, বরং দেশি মুরগির মতো হয়ে থাকে। গাবা সমৃদ্ধ খাদ্যের মাধ্যমে ব্রয়লার উৎপাদের খরচও অনেক কম। গাবা পানিতে মিশিয়েও খাওয়ানো যায়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গাবার চকলেট পাওয়া যায়। গাবা সমৃদ্ধ খাদ্য সহজলভ্য করার জন্য বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার সাথে কথা চলছে, যেন খামারীরা উপকৃত হতে পারে।

ব্রয়লার মুরগি
গবেষকদল

গবেষণার সাথে সংশ্লিষ্ট প্রধান গবেষক ও শের-ই-বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি এন্ড টক্সিকোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোছা. শরীফা জাহান লাবনী বলেন, এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল- ব্রয়লার মুরগির বৃদ্ধির উপর উচ্চ তাপজনিত প্রভাব মূল্যায়ন করা, তাপ ও চাপের পরিস্থিতিতে ব্রয়লারদের তাপ স্থিতিস্থাপকতা এবং কর্মক্ষমতা উন্নত করতে গাবাসমৃদ্ধ খাদ্যের সম্ভাবনা যাচাই করা, ডোজের মাত্রা এবং বিতরণ পদ্ধতি বিবেচনা করে গাবা-সমৃদ্ধ খাদ্যের প্রণয়ন করা এবং বাণিজ্যিক ব্রয়লার উৎপাদন ব্যবস্থায় গাবা-সমৃদ্ধ খাদ্য বাস্তবায়নের জন্য ব্যবহারিক সুপারিশ প্রদান করা।

গবেষণার সফলতার দিক তুলে ধরে তিনি বলেন, গাবা সমৃদ্ধ বিশেষ খাদ্য গ্রহণের ফলে ব্রয়লারের ওজন বাড়ে, সাথে পুষ্টি শোষণ ও হজম দক্ষতা বাড়ে। কর্টিসল নামক স্ট্রেস হরমোন কমায় তাপমাত্রা জনিত মানসিক ও শারীরিক চাপ কমে। পাশাপাশি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়ায়। অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে কোষের ক্ষয় রোধ, প্রদাহ হ্রাস ও ইমিউন সেল শক্তিশালী করতে উপযোগী গাবা সমৃদ্ধ খাদ্য। এর ফলে রোগের হার ও মৃত্যুহার কমে যায়, অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার কমে। একই সাথে উৎপাদন খরচ কম ও অধিক উৎপাদনের মাধ্যমে লাভের হার বেড়ে যায়

এ গবেষক আরও বলেন, বাংলাদেশের গ্রীষ্মকাল ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে এই উদ্ভাবন ব্রয়লার শিল্পে এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিতে পারে। গাবা-সমৃদ্ধ খাদ্যের প্রসার ঘটলে দেশের মাংস উৎপাদন বৃদ্ধি ও খামারিদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়ন সম্ভব হবে। গাবা একটি প্রাকৃতিক অন্তঃসৃষ্ট যৌগ, যা দ্রুত বিপাকিত হয়। তাই সাধারণত এটি অবশিষ্টাংশ হিসেবে কোস বা টিস্যুতে জমা হয় না।

গাবা সমৃদ্ধ খাদ্য ব্যবহার করে ব্রয়লার উৎপাদনে সফলতা পেয়েছেন ময়মনসিংহের খামারি আব্দুল হাই। তিনি বলেন, গত বছর তীব্র গরমে আমার খামারের তিনশ মুরগি মারা গিয়েছিল। পরে স্যারেরা আমাকে ছয়শ মুরগি দিলেন, যেগুলোতে গাবা সমৃদ্ধ খাদ্য প্রদান করা হয়। পাশাপাশি আমি কিনলাম আরও ছয়শ মুরগি। মুরগির বয়স যখন ২৫ দিন হয়ে গেল, তখন আমার অংশের মুরগি মারা যেতে শুরু করে, তবে স্যারের মুরগি একটিও মারা যায়নি। ৩০ দিনে ওজন এসেছে দুই কেজির বেশি। আগে ১ হাজার ২০০ মুরগি পালন করতে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকার ওষধ লাগত, এখন সেই ওষুধের খরচ সাশ্রয় হয়। মুরগিগুলো যাদের কাছে বিক্রি করা হয়েছে তারা জানিয়েছেন স্বাদ ও ঘ্রাণে সাধারণ ব্রয়লার মুরগির চেয়ে উন্নত ছিল।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -

সর্বশেষ

কমলা চাষ করে সফল মাদারীপুরের রাসেল

মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার দত্তপাড়া মৃধাকান্দি এলাকায় কমলা চাষ করে নতুন সম্ভাবনার দিগন্ত উন্মোচন করেছেন তরুণ উদ্যোক্তা রাসেল হোসেন।দীর্ঘ প্রবাস জীবন শেষে দেশে ফিরে বাবার...

পুরোনা আলু সংরক্ষণ করার অনুরোধ কৃষি উপদেষ্টার

আলুচাষিদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ডিসেম্বর পর্যন্ত পুরোনো আলু সংরক্ষণ করতে বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনকে অনুরোধ জানিয়েছেন কৃষি ও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো....

দেশে ব্রুসেলা জীবাণুর ভ্যাকসিন উদ্ভাবন

দেশে গবাদিপশুর অন্যতম পরিচিত রোগ হলো ব্রুসেলোসিস। ব্রু‌সেলা অ‌্যা‌বর্টাস (Brucella abortus) নামক এক ধরনের ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে এ রোগ হয়। এই জীবাণুতে গবাদিপশু আক্রান্ত হ‌লে...

ইউটিউব দেখে ‘কালো ধান’ চাষে সাফল্য

ব্ল‍্যাক রাইস বা কালো ধান। কেউ বলেন ‘প্রিন্স অফ রাইস’। এ ধানের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। এ চাহিদা মেটাতে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের উত্তরবঙ্গের কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার...