Saturday, December 13, 2025
Advertisement
Home কৃষি ক্যাম্পাস হাওরের খাদ্য নিরাপত্তায় বাকৃ‌বি গ‌বেষক‌দের বি‌শেষ উ‌দ্যোগ

হাওরের খাদ্য নিরাপত্তায় বাকৃ‌বি গ‌বেষক‌দের বি‌শেষ উ‌দ্যোগ

বাংলাদেশের হাওর অঞ্চলসমূহে দীর্ঘদিন ধরে মৌসুমি বন্যা, যাতায়াতের সীমাবদ্ধতা ও অবকাঠামোগত ঘাটতির কারণে সুবিধাবঞ্চিত এলাকা হিসেবে পরিচিত। হাওরের অধিকাংশ মানুষ এককালীন কৃষির ওপর নির্ভরশীল, ফলে তাদের আয় সবসময় অনিশ্চিত থেকে যায়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণে এই অঞ্চলে পর্যটনের প্রসার ঘটছে, যা নতুন অর্থনৈতিক সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে। কিন্তু নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর খাবারের অভাব এ সম্ভাবনার পূর্ণ ব্যবহারকে বাধাগ্রস্ত করছে।

এই পরিস্থিতির উন্নয়নে এগিয়ে এসেছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক। বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন শিক্ষক, দুজন ছাত্র এবং খাদ্য নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষের একজন অভিজ্ঞ সদস্যের সমন্বয়ে টিম গঠন করে হাওরের খাদ্য ব্যবসায়ীদের প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হয়। এর ফলে বর্তমানে খাদ্য নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যবিধির উন্নয়ন ঘটেছে। প্রশিক্ষক দলের শিক্ষকরা হলেন- বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. ছাদেকা হক, ফুড টেকনোলজি ও গ্রামীণ শিল্প বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আব্দুল আলীম, মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোছা. সোনিয়া পারভীন।

২০২৩ সালে সিটি ব্যাংকের অর্থায়নে “বাংলাদেশের হাওড় অঞ্চলে খাদ্য ব্যবসায় নিয়োজিতদের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা এবং স্বাস্থ্যবিধি বিষয়ক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি” শীর্ষক প্রকল্পটি শুরু হয়। বাকৃবি রিসার্চ সিস্টেম (বাউরেস) প্রকল্পটির সমন্বয় করে।

এ বিষয়ে অধ্যাপক ড. সাদিকা হক বলেন, ‘হাওরাঞ্চলে খাদ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্প সম্ভাবনাময় হলেও স্থানীয়দের মধ্যে পর্যাপ্ত জ্ঞান, পরিবহন ও অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতার ফলে পর্যটকেরা স্থানীয় হোটেলগুলোতে খাবার খেয়ে প্রায়ই নেতিবাচক অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরছেন। এ অবস্থা চলতে থাকলে হাওড় অঞ্চলের পর্যটন শিল্প মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এটি উপলব্ধি করে আমরা স্থানীয় হোটেল মালিক ও কর্মচারীদের জন্য মানসম্মত খাদ্য নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যবিধি বিষয়ক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করি।

তিনি আরও বলেন,  এই প্রশিক্ষণের মূল উদ্দেশ্য ছিল হাওরাঞ্চলে নিরাপদ খাবার প্রস্তুত ও পরিবেশন সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি , যা পর্যটনশিল্পকে টেকসই করার পাশাপাশি স্থানীয় জনগণের জন্যও নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করবে। আমাদের টিমের বিশেষজ্ঞ সদস্য অধ্যাপক ড. মো আব্দুল আলীম নেতৃত্বে আমরা একটি কার্যকর প্রশিক্ষণ মডিউল প্রণয়ন করি। ২০২৩ সালে বাকৃবি এবং সিটি ব্যাংকের যৌথ উদ্যোগে হাওর অঞ্চলে গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়। এই কর্মসূচি স্থানীয় নারী-পুরুষদের জন্য শুধু খাদ্য নিরাপত্তা ও স্যানিটেশনেই নয়, বরং পর্যটকবান্ধব সেবা গড়ে তুলতেও ভূমিকা রাখবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।

প্রশিক্ষণ কার্যক্রম ও মাঠ পর্যায়রে অভজ্ঞিতা নিয়ে ড. মোছা. সোনিয়া পারভীন বলেন, ২০২৩ সালের মার্চে আমরা প্রথমবার মিঠামইন, নিকলী ও অষ্টগ্রাম এলাকা পরিদর্শন করি এবং স্থানীয় হোটেলগুলোতে অপরিচ্ছন্ন ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ লক্ষ্য করি। পরবর্তী সময়ে এসব সমস্যা বিবেচনায় নিয়ে স্থানীয় রেস্টুরেন্ট কর্মীদের জন্য বাংলাদেশ খাদ্য নিরাপত্তা অধিদপ্তরের নিয়ম অনুযায়ী একটি প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করি। প্রথমে মিঠামইনে প্রায় ৩০ জন নারী-পুরুষকে, পরে নিকলিতে আরও ৩০-৩৫ জনকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। কয়েক ধাপে শতাধিক হোটেল মালিক, কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে

তিনি আরও বলেন, প্রথমদিকে মানুষ একদম অনীহা প্রকাশ করেছেন এবং তাদের মনোভাব এমন ছিল যে তারা পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বিষয়ক সবই জানে। তারপর তাদের সাথে ধীরে ধীরে কথা বলে বুঝিয়ে প্রশিক্ষণে আনা হয়েছে। সেখানে গিয়ে ট্রেনিং করার মত ভালো জায়গা খুঁজে বের করা, পর্যাপ্ত সৌচাগারের অভাব, যাতায়াতের সীমাবদ্ধতাসহ নানাবিধ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে আমরা প্রশিক্ষণটি সম্পন্ন করেছি।

প্রশিক্ষণ বিষয়ে অধ্যাপক ড. মো আব্দুল আলীম বলেন, প্রশিক্ষণে মূলত খাদ্য উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, খাদ্য প্রস্তুত, প্যাকেজিং, সংরক্ষণ, পরিবহন, বিতরণ, বিক্রয়, এবং সরবরাহ নিয়ে আলোচনা করা হয়। প্রশিক্ষণে হাওর অঞ্চলের খাদ্য নিরাপত্তা বিবেচনার ক্ষেত্রে খাদ্য প্রক্রিয়াজাত ও পরিবেশনকারী কর্মীদের ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি, সাধারণ পরিচ্ছন্নতা, খাদ্য স্বাস্থ্যবিধি, খাদ্য দূষণ ও সংরক্ষণ এবং রোগব্যাধি বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সচেতন করা হয়। কাজ করার সময় চুল ঢেকে রাখা, নখ ছোট, ক্ষত থাকলে ব্যান্ডেজ এবং গ্লাভস, গয়না-ঘড়ি ইত্যাদি পরে কাজ না করা, হাতধোয়ার জন্য আলাদা বেসিন, ঢাকনাযুক্ত ডাস্টবিন, পোকা–মাকড় নিয়ন্ত্রণ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, কাঁচা রান্না করা আলাদা বোর্ড, ছুরি ব্যবহার বিষয়ে হাতে কলমে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।

প্রশিক্ষণের সফলতার বিষয়ে তিনি বলেন, কর্মীরা এখন নিয়মিত নিজেরাও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকছেন এবং ভোক্তাদেরও ময়লা নির্দিষ্ট স্থানে ফেলার ব্যপারে সতর্ক করছেন। কর্মী ও ভোক্তার জন্য ওয়াশরুম, পানি, সাবান, টিস্যু ও ঢাকনাযুক্ত ডাস্টবিন নিশ্চিত করা হয়েছে। প্রতিটি সার্ভিংয়ে প্লেটের সাথে টিস্যুর ব্যবহার হচ্ছে। কাঁচা এবং রান্না করা খাবার আলাদা রাখতেও দেখা যাচ্ছে এখন। দ্রুত এবং ভদ্রভাবেই খাবার পরিবেশনের বিষয়টি এখন চোখে পরার মতো । যা সব মিলিয়ে গ্রাহকের অভিজ্ঞতা এখন  স্পষ্টতই উন্নত। পাশাপাশি হোটেলগুলোতে প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হয়েছে, যা নতুন কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি করছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, মিঠামইনের একাধিক হোটেলে বর্তমানে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। সেখানে ভাটি বাংলা রেস্টুরেন্টের এক কর্মচারী বলেন, হোটেল কর্মচারী, আমরা মিঠামইনে ১৮ বছর যাবৎ হোটেলের ব্যবসা করছি। আগে আমরা এত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ছিলাম না। স্যার, ম্যাডামরা এসে আমাদের কয়েক দফায় প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। এখন আমাদের মধ্যেও পরিবর্তন এসেছে। পাশাপাশি কাজের জন্য লোকসংখ্যাও বেড়েছে, এজন্য স্যারদের প্রতি কৃতজ্ঞতা।

সন্তুষ্টির কথা জানিয়েছেন স্থানীয় ভোক্তা ও পর্যটকেরা। তারা জানান, খাবারের মান ও পরিবেশ আগের চেয়ে উন্নত হয়েছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -

সর্বশেষ

কমলা চাষ করে সফল মাদারীপুরের রাসেল

মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার দত্তপাড়া মৃধাকান্দি এলাকায় কমলা চাষ করে নতুন সম্ভাবনার দিগন্ত উন্মোচন করেছেন তরুণ উদ্যোক্তা রাসেল হোসেন।দীর্ঘ প্রবাস জীবন শেষে দেশে ফিরে বাবার...

পুরোনা আলু সংরক্ষণ করার অনুরোধ কৃষি উপদেষ্টার

আলুচাষিদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ডিসেম্বর পর্যন্ত পুরোনো আলু সংরক্ষণ করতে বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনকে অনুরোধ জানিয়েছেন কৃষি ও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো....

দেশে ব্রুসেলা জীবাণুর ভ্যাকসিন উদ্ভাবন

দেশে গবাদিপশুর অন্যতম পরিচিত রোগ হলো ব্রুসেলোসিস। ব্রু‌সেলা অ‌্যা‌বর্টাস (Brucella abortus) নামক এক ধরনের ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে এ রোগ হয়। এই জীবাণুতে গবাদিপশু আক্রান্ত হ‌লে...

ইউটিউব দেখে ‘কালো ধান’ চাষে সাফল্য

ব্ল‍্যাক রাইস বা কালো ধান। কেউ বলেন ‘প্রিন্স অফ রাইস’। এ ধানের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। এ চাহিদা মেটাতে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের উত্তরবঙ্গের কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার...