দেশের বরেন্দ্রাঞ্চলের তিন জেলা রাজশাহী, নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে আল্ট্রা হাই-ডেনসিটি ম্যাঙ্গো প্ল্যান্টেশন (ইউএইচডিএমপি) পদ্ধতি বা উচ্চ ঘনত্বে আমচাষ ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এই পদ্ধতিতে চাষ করে আমের শুধু ফলনই বাড়েনি, দ্বিগুণ করেছে কৃষকের আয়ও। বিশেষ করে গত কয়েক বছর ধরে এটি বরেন্দ্র এলাকার কৃষিতে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।
নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার এনায়েতপুর গ্রামের কৃষক রফিকুল ইসলাম (৫৪) ২০১৯ সালে ৩৫ শতক জমিতে ১৩০টি আম্রপালি, ৪০টি বারি-৪ ও ৫টি ব্যানানা আম গাছ নিয়ে একটি ইউএইচডিএমপি আমবাগান গড়ে তোলেন।এরপর, কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শে ছয় বছর ধরে নিয়মিত পরিচর্যা করে তিনি গত বছর আম বিক্রি করে দেড় লাখ টাকা আয় করেন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার শেরপুর গ্রামের শাহিন আক্তার বলেছেন, ‘এই পদ্ধতিতে চাষ করে অন্য যেকোনো ফসলের চেয়ে অনেক বেশি আয় হচ্ছে।’
একই জেলার নাচোল উপজেলার বাইলকাপাড়া গ্রামের হেফাজ উদ্দিন (৬৫) এই আমচাষ পদ্ধতি গ্রহণ করে দ্বিগুণ সুফল পেয়েছেন। তিনি ২০২১ সালে ৮৪টি গাছ থেকে আম তুলেছিলেন এবং তা বিক্রি করে ৫১ হাজার ১২০ টাকা আয় করেছেন। তিনি বলেন, ‘গাছ প্রতি গড়ে ৬ থেকে ৭ কেজি ফল পেয়েছি।’
নতুন কৃষি প্রযুক্তি প্রয়োগে জমি থেকে আরও বেশি আয় হবে বলে আশা করছেন হেফাজ উদ্দিন। এই পদ্ধতি দ্বিগুণ ফলন দিয়ে অতিরিক্ত আয় নিশ্চিত করছে, যা এলাকার মানুষের জীবনমান উন্নত করতে সাহায্য করছে।
তিনি ২০১৮ সালে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) কর্মকর্তাদের কারিগরি সহায়তায় ইউএইচডিএমপি পদ্ধতি ব্যবহার করে এক একর জমিতে ১০০টি বারি-৪ আম গাছ রোপণ করেন।
রাজশাহীর গোদাগাড়ীর চব্বিশনগর গ্রামের জিয়ারুল ইসলাম (৩৮) গত বছর ১৬০টি গাছ থেকে আম বিক্রি করে ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা আয় করেছেন।
তিনি বলেন, ইউএইচডিএমপি পদ্ধতিতে গড়া আমবাগান বাড়তি আয় নিশ্চিত করছে, ফলে কৃষক পরিবারের জীবনমান উন্নত হচ্ছে।
তানোর উপজেলার টকটকিয়া গ্রামের তরুণ আমচাষি রুবেল হোসেন (৩২) এই পদ্ধতিতে আমচাষ করে হয়ে উঠেছেন এলাকার অনুকরণীয় চাষি।
তিনি জানান, ১৩০টি গাছ থেকে গত মৌসুমে ৯১৬ কেজি আম বিক্রি করে ৫৫ হাজার টাকা আয় হয়েছে। নতুন কৃষি পদ্ধতি ব্যবহার করলে তুলনামূলক কম পরিশ্রমে এক খণ্ড জমি থেকেও বেশি আয় করা সম্ভব, আর এই আয় ধীরে ধীরে আরও বাড়বে।
এই পদ্ধতি গ্রহণ করে এ অঞ্চলের আরও অনেক কৃষকই আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছেন। ইউএইচডিএমপি এখন আম চাষে একটি বিপ্লব বয়ে এনেছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক মনজুরুল হুদা বলেন, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বে এই আমচাষ পদ্ধতি কৃষিখাতে নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলেছে। রাজশাহী, নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় আম্রপালি, বারি আম-৩ ও ৪-এর মতো উচ্চ ফলনশীল জাতের বাগান প্রতি বছরই বাড়ছে।
তিনি জানান, ইউএইচডিএমপি পদ্ধতিতে ২ থেকে ৩ বছরের মধ্যেই ফল পাওয়া যায়, যেখানে প্রচলিত ব্যবস্থায় সময় লাগে ৮ থেকে ৯ বছর। এই পদ্ধতিতে প্রতি বিঘায় ২০০টি পর্যন্ত গাছ রোপণ করা যায়, যেখানে সাধারণ পদ্ধতিতে হয় মাত্র ১০টি।
উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা অতনু সরকার বলেছেন, ছোট জাতের আমগাছ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে কারণ এতে একই জমিতে বেশি গাছ রোপণ করা যায় এবং ফল পেতে সময়ও কম লাগে।
আঞ্চলিক ফল গবেষণা কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শফিকুল ইসলাম বলেন, ইউএইচডিএমপি সফল করতে সঠিক সময়ের সেচ, সার ও ছাঁটাই জরুরি।
তিনি বলেন, জুলাই ১৫-এর মধ্যে গাছ ছাঁটাই করা জরুরি, যাতে ফলন্ত ডাল গঠিত হয় ও ছায়াঘনতা নিয়ন্ত্রণে থাকে। ছাঁটাইয়ের এক মাস পর গজানো নতুন কুঁড়ি পাতলা করে দিতে হয় যাতে ডালে ভিড় না হয়।এই পদ্ধতিতে ফলন তিনগুণ বাড়ানো সম্ভব, সেচের পানি কমে ৫০ শতাংশ এবং সার শোষণ ক্ষমতাও বাড়ে।
