গবাদিপশুর ব্রুসেলোসিস রোগের পূর্বাভাস শনাক্ত করতে একটি নতুন ধরনের মেশিন লার্নিং প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) একদল গবেষক। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে ব্যয়বহুল ল্যাব টেস্ট ছাড়াই সহজে এ রোগের পূর্বাভাস এবং রোগ শনাক্ত করা যাবে। এ ছাড়া এই রোগের চিকিৎসায় অক্সিটেট্রাসাইক্লিন, স্ট্রেপটোমাইসিন এবং বেনজাইল পেনিসিলিন একত্রে প্রয়োগে কার্যকর ফল দেয় বলে দাবি গবেষকদের।
বাকৃবির ভেটেরিনারি অনুষদের মেডিসিন বিভাগের প্রধান গবেষক অধ্যাপক ড. মো. সিদ্দিকুর রহমান এবং তার পিএইচডি গবেষণারত শিক্ষার্থী কর্নেল (অব.) এস এম আজিজুল করিম হুসাইনী এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন। এই গবেষণায় আরও যুক্ত ছিলেন জার্মানির ফ্রেডেরিখ লোফলর ইনস্টিটিউটের ড. হেনরিখ নইবার। গবেষণায় প্রযুক্তিগত সুবিধা প্রদান করেছে সৌদি আরবের কিং ফয়সাল বিশ্ববিদ্যালয়।
গত ৪ মে গবেষণাটি এশিয়ান জার্নাল অব অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড বায়োলজি সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে।
অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘বর্তমান বিশ্বে মেশিন লার্নিং অ্যালগরিদম মানুষের হৃদরোগ, কিডনি সমস্যা, ডায়াবেটিস, শ্বাসতন্ত্রের রোগ ইত্যাদি নির্ণয়ে ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে দেশে আমরাই প্রথমবার এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে গবাদিপশুর ব্রুসেলোসিসের পূর্বাভাস ও রোগ শনাক্ত করতে সম্ভব হয়েছি।’
তিনি বলেন, ‘এই মেশিন লার্নিং ব্যবহারের জন্য একজন কৃষক শুধু খামারের ব্যবস্থাপনার এবং গবাদিপশুর রোগ সংক্রান্ত কিছু নমুনা প্রদান করলেই জানতে পারবেন তার প্রাণীটি ব্রুসেলোসিসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে কি না। তিনি রোগের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত গুরুত্বপূর্ণ ঝুঁকি উপাদানগুলো সম্পর্কেও ধারণা পাবেন। এরপর তিনি খামারে উপযুক্ত জীবনিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং ব্রুসেলা ভ্যাকসিন প্রয়োগ করে রোগটি সহজে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারবেন। এতে করে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির ঝুঁকি অনেকটাই কমে যাবে।’
সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ব্রুসেলোসিস রোগটি ব্রুসেলা নামক ব্যাকটেরিয়ার কারণে হয়, যা জুনোটিক অর্থাৎ পশু থেকে মানুষের শরীরে ছড়াতে পারে। গাভি এই রোগে আক্রান্ত হলে গর্ভপাত হয় এবং দুধ উৎপাদন হ্রাস যায়। অনেক সময় গর্ভফুল ও বাছুর মরে গাভির শরীরের ভেতরেই থেকে যায়, যা গাভির প্রজনন অঙ্গের মারাত্মক ক্ষতি করে। ফলে খামারিদের বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হতে হয়।
তিনি বলেন, এ ছাড়া নারীরা এই জীবাণু দ্বারা সংক্রামিত হলে গর্ভপাত এবং পুরুষের ক্ষেত্রে টেস্টিসে প্রদাহ ও বন্ধ্যাত্বের মতো জটিলতা দেখা দেয়। বর্তমানে দেশে ব্যবহৃত ব্রুসেলা আবর্টাস (এস-১৯) এবং আরবি৫১ লাইভ ভ্যাকসিনে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ঝুঁকি রয়েছে। তবে ‘কিল্ড ভ্যাকসিন’ নিরাপদ এবং কার্যকর বলে গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে।
মেশিন লার্নিং মডেল তৈরির বিষয়ে কর্নেল (অব.) এস এম আজিজুল করিম বলেন, এটি তৈরি করতে সাভারের মিলিটারি ডেইরি ফার্ম এবং সেন্ট্রাল ক্যাটল ব্রিডিং ডেইরি ফার্ম থেকে গরুর প্রজনন সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য যেমন—বারবার প্রজননে ব্যর্থতা, গর্ভফুল না পড়া, গর্ভপাত, গাভীর বয়স এবং বাচ্চা প্রসবের ইতিহাস ইত্যাদি সংগ্রহ করে একটি প্রশ্নাবলী (কোশ্চেননারি) প্রস্তুত করা হয়। এ ছাড়া মোট ৪৬০টি নমুনা সংগ্রহ করে ল্যাবে রোজ বেঙ্গল টেস্ট করা হয়।
তিনি বলেন, এরপর এই নমুনা ও তথ্যের মধ্যে ভারসাম্য আনার জন্য সিনথেটিক মাইনোরিটি ওভার সেম্পোলিং টেকনিক (এসএমওটিই) ব্যবহার করা হয়। এটি একটি জনপ্রিয় ওভারস্যাম্পলিং পদ্ধতি, যা ডেটাসেটে শ্রেণির অসামঞ্জস্য দূর করে। পরবর্তীতে, সহজে ব্রুসেলোসিস রোগ শনাক্ত করার জন্য পাঁচটি মেশিন লার্নিং অ্যালগরিদম ব্যবহার করা হয়। প্রতিটি মডেলের নির্ভুলতা যাচাই করতে ১০-ভাঁজ ক্রস-ভ্যালিডেশন পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। এই পাঁচটি অ্যালগরিদমের মধ্যে দুটি অ্যালগরিদম সবচেয়ে ভালো ফলাফল দিয়েছে। এগুলো হলো মাল্টিলেয়ার পারসেপট্রনের ( এমএলপি) নির্ভুলতা ৯৩.৫৯ শতাংশ এবং ওয়েকা ডিপলার্নিং ৪জের নির্ভুলতা ৯৩.৯৪ শতাংশ।
আজিজুল করিম আরও বলেন, এই প্রযুক্তি দেশের পশুসম্পদের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। খামারিদের পশু চিকিৎসার ব্যয় কমাবে এবং সহজেই রোগ শনাক্ত করতে পারবেন। এই প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ভবিষ্যতে দেশে ব্রুসেলোসিস প্রতিরোধে একটি যুগান্তকারী টিকা উদ্ভাবনের সম্ভাবনা রয়েছে।
উল্লেখ্য, বিশ্বে এখন পর্যন্ত ব্রুসেলা ব্যাকটেরিয়ার ১২টি প্রজাতি শনাক্ত হয়েছে, যার মধ্যে বেশিরভাগই ক্ষতিকর। গরুর ক্ষেত্রে সাধারণত ব্রুসেলা আবর্টাস বেশি দেখা যায়, যদিও ব্রুসেলা মেলিটেনসিস সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর এবং ব্রুসেলা সুইস অপেক্ষাকৃত কম। গরু একবার আক্রান্ত হলে আজীবন তার শরীরে জীবাণু বহন করে।
